ঢাকা   সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
দৈনিক রেলওয়ে বার্তা

বালাস্ট নয়, অপপ্রচার—বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র



বালাস্ট নয়, অপপ্রচার—বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র

 বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সম্প্রতি যে অভিযোগসমূহ সামাজিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে—“বোল্ডারের বদলে চুনাপাথর ব্যবহার করে ১৫০ কোটি টাকা লোপাট”—তাহলেই তা শুধুই বিভ্রান্তিকর নয়, বরং প্রকৌশলগত অজ্ঞতা, অর্ধসত্য তথ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের জঘন্য উদাহরণ। রেলপথের মতো উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো খাতে ‘পাথর বনাম পাথর’ বিতর্ক সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির গল্প ফাঁদা যতটা সহজ, বাস্তবতা ততটাই কঠিন, জটিল ও বহুমাত্রিক।

প্রথমেই পরিষ্কার করতে হবে—রেললাইনের নিচে ব্যবহৃত ‘বালাস্ট’ কোনো একক পাথরের নাম নয়, এটি একটি প্রকৌশলগত মানদণ্ড। আন্তর্জাতিক রেলওয়ে প্রকৌশলে বালাস্ট হিসেবে গ্রানাইট, ডোলোমাইট, বেসাল্ট সহ একাধিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। কোন ধরনের পাথর ব্যবহার হবে তা নির্ভর করে ভূ-প্রকৃতি, লোড, ট্রাফিক ডেনসিটি, ড্রেনেজ এবং রক্ষণাবেক্ষণ কৌশলের ওপর।

পাথরের গুণাবলী নির্ধারণের প্রকৌশলগত মান

ব্যালাস্টের প্রকৌশল মান নির্ধারিত হয় LA Abrasion Value, LA Impact Value, Water Absorption, Mill Abrasion Test, Bulk Specific Gravity ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে—পাথরের নাম দিয়ে নয়। মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোথাও BSTI বা আন্তর্জাতিক মান পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল নেই, বরং আংশিক নমুনা পরীক্ষার উল্লেখ করে একটি সামগ্রিক সিদ্ধান্ত টেনে নেওয়া হয়েছে—যা সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতিরও পরিপন্থী।

১৫০ কোটি টাকার “লোপাট”—কীভাবে?

সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং দুর্বল অভিযোগ হলো, প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ও বাস্তব ব্যয়ের পার্থক্যকে সরাসরি দুর্নীতি হিসেবে উপস্থাপন। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ডিজাইন পরিবর্তন, ভূ-গর্ভস্থ বাস্তবতার পরিবর্তন, মুদ্রাস্ফীতি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং শ্রম ও যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি—all এ ধরনের কারণে ভ্যারিয়েশন অর্ডার করা হয়। এগুলো সরকারি বিধিমালার আওতাধীন। প্রতিবেদনে কোথাও ভ্যারিয়েশন অনুমোদনের নথি, পিপিআর, পিডিপিপি বা পিএসসি সভার সিদ্ধান্তের পূর্ণ বিবরণ নেই। শুধুমাত্র বড় অঙ্কের সংখ্যা ছুড়ে দিয়ে ‘লোপাট’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—যা মানহানিকর এবং আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

অপপ্রচারের নেপথ্য উদ্দেশ্য

বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে। এই সময়ে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, প্রকৌশল সিদ্ধান্তকে দুর্নীতির মোড়কে উপস্থাপন এবং কর্মকর্তাদের পেশাগত মর্যাদা ক্ষুন্ন করা—এসবের মাধ্যমে একটি Institutional Destabilization Narrative তৈরি করা হচ্ছে। আগেও দেখা গেছে, রেলওয়ের যেকোনো বড় প্রকল্পে নির্দিষ্ট মহল ‘দুর্নীতি’ শব্দটি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে।

এডিবি ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার দৃষ্টিকোণ

প্রতিবেদনে এডিবির নাম ব্যবহার করা হলেও কোথাও ADB-এর অফিসিয়াল Objection, Red Flag Report বা Procurement Suspension-এর তথ্য নেই। এডিবি কোনো প্রকল্পে মানহীন উপাদান ব্যবহারে চোখ বন্ধ রাখে না। প্রকৃত অর্থেই যদি ব্যবহৃত ব্যালাস্ট মানহীন হতো, তবে প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত হতো।

গঠনমূলক সমাধান

সমালোচনা হোক—কিন্তু তথ্যভিত্তিক, নথিনির্ভর ও দায়িত্বশীল।

এই প্রেক্ষাপটে প্রস্তাব করা হলো-

১. প্রকল্পের চুক্তির আওতাভুক্ত সকল ব্যালাস্ট টেস্ট রিপোর্ট প্রকাশ করা হোক।

২. স্বীকৃত পরীক্ষাগারে প্রয়োজন অনুসারে চুক্তির সংস্হানকৃত ব্যালাস্টের গুণগত মান পুনরায় পরীক্ষা করা হোক।

৩. সাংবাদিকদের জন্য Technical Briefing Session চালু করা হোক।

কিন্তু তার আগে প্রয়োজন—অপপ্রচার বন্ধ করা।

রেললাইন কেবল পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না, দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাস, পেশাদারিত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার ওপর। দায়িত্বজ্ঞানহীন শিরোনাম, অর্ধসত্য তথ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ দিয়ে জাতীয় অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করা।

আজকের বাস্তব লড়াই বোল্ডার বনাম চুনাপাথরের নয়—

এটি সত্য বনাম অপপ্রচারের

আপনার মতামত লিখুন

দৈনিক রেলওয়ে বার্তা

সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫


বালাস্ট নয়, অপপ্রচার—বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র

প্রকাশের তারিখ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

featured Image

 বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সম্প্রতি যে অভিযোগসমূহ সামাজিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে—“বোল্ডারের বদলে চুনাপাথর ব্যবহার করে ১৫০ কোটি টাকা লোপাট”—তাহলেই তা শুধুই বিভ্রান্তিকর নয়, বরং প্রকৌশলগত অজ্ঞতা, অর্ধসত্য তথ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের জঘন্য উদাহরণ। রেলপথের মতো উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো খাতে ‘পাথর বনাম পাথর’ বিতর্ক সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির গল্প ফাঁদা যতটা সহজ, বাস্তবতা ততটাই কঠিন, জটিল ও বহুমাত্রিক।

প্রথমেই পরিষ্কার করতে হবে—রেললাইনের নিচে ব্যবহৃত ‘বালাস্ট’ কোনো একক পাথরের নাম নয়, এটি একটি প্রকৌশলগত মানদণ্ড। আন্তর্জাতিক রেলওয়ে প্রকৌশলে বালাস্ট হিসেবে গ্রানাইট, ডোলোমাইট, বেসাল্ট সহ একাধিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। কোন ধরনের পাথর ব্যবহার হবে তা নির্ভর করে ভূ-প্রকৃতি, লোড, ট্রাফিক ডেনসিটি, ড্রেনেজ এবং রক্ষণাবেক্ষণ কৌশলের ওপর।

পাথরের গুণাবলী নির্ধারণের প্রকৌশলগত মান

ব্যালাস্টের প্রকৌশল মান নির্ধারিত হয় LA Abrasion Value, LA Impact Value, Water Absorption, Mill Abrasion Test, Bulk Specific Gravity ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে—পাথরের নাম দিয়ে নয়। মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোথাও BSTI বা আন্তর্জাতিক মান পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল নেই, বরং আংশিক নমুনা পরীক্ষার উল্লেখ করে একটি সামগ্রিক সিদ্ধান্ত টেনে নেওয়া হয়েছে—যা সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতিরও পরিপন্থী।

১৫০ কোটি টাকার “লোপাট”—কীভাবে?

সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং দুর্বল অভিযোগ হলো, প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ও বাস্তব ব্যয়ের পার্থক্যকে সরাসরি দুর্নীতি হিসেবে উপস্থাপন। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ডিজাইন পরিবর্তন, ভূ-গর্ভস্থ বাস্তবতার পরিবর্তন, মুদ্রাস্ফীতি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং শ্রম ও যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি—all এ ধরনের কারণে ভ্যারিয়েশন অর্ডার করা হয়। এগুলো সরকারি বিধিমালার আওতাধীন। প্রতিবেদনে কোথাও ভ্যারিয়েশন অনুমোদনের নথি, পিপিআর, পিডিপিপি বা পিএসসি সভার সিদ্ধান্তের পূর্ণ বিবরণ নেই। শুধুমাত্র বড় অঙ্কের সংখ্যা ছুড়ে দিয়ে ‘লোপাট’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—যা মানহানিকর এবং আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

অপপ্রচারের নেপথ্য উদ্দেশ্য

বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে। এই সময়ে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, প্রকৌশল সিদ্ধান্তকে দুর্নীতির মোড়কে উপস্থাপন এবং কর্মকর্তাদের পেশাগত মর্যাদা ক্ষুন্ন করা—এসবের মাধ্যমে একটি Institutional Destabilization Narrative তৈরি করা হচ্ছে। আগেও দেখা গেছে, রেলওয়ের যেকোনো বড় প্রকল্পে নির্দিষ্ট মহল ‘দুর্নীতি’ শব্দটি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে।

এডিবি ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার দৃষ্টিকোণ

প্রতিবেদনে এডিবির নাম ব্যবহার করা হলেও কোথাও ADB-এর অফিসিয়াল Objection, Red Flag Report বা Procurement Suspension-এর তথ্য নেই। এডিবি কোনো প্রকল্পে মানহীন উপাদান ব্যবহারে চোখ বন্ধ রাখে না। প্রকৃত অর্থেই যদি ব্যবহৃত ব্যালাস্ট মানহীন হতো, তবে প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত হতো।

গঠনমূলক সমাধান

সমালোচনা হোক—কিন্তু তথ্যভিত্তিক, নথিনির্ভর ও দায়িত্বশীল।

এই প্রেক্ষাপটে প্রস্তাব করা হলো-

১. প্রকল্পের চুক্তির আওতাভুক্ত সকল ব্যালাস্ট টেস্ট রিপোর্ট প্রকাশ করা হোক।

২. স্বীকৃত পরীক্ষাগারে প্রয়োজন অনুসারে চুক্তির সংস্হানকৃত ব্যালাস্টের গুণগত মান পুনরায় পরীক্ষা করা হোক।

৩. সাংবাদিকদের জন্য Technical Briefing Session চালু করা হোক।

কিন্তু তার আগে প্রয়োজন—অপপ্রচার বন্ধ করা।

রেললাইন কেবল পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না, দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাস, পেশাদারিত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার ওপর। দায়িত্বজ্ঞানহীন শিরোনাম, অর্ধসত্য তথ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ দিয়ে জাতীয় অবকাঠামো প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করা।

আজকের বাস্তব লড়াই বোল্ডার বনাম চুনাপাথরের নয়—

এটি সত্য বনাম অপপ্রচারের


দৈনিক রেলওয়ে বার্তা

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মো: মনিরুজ্জামান (মনির) 

কপিরাইট © ২০২৫ দৈনিক রেলওয়ে বার্তা । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত